ইচ্ছেডানা
-অণুশ্রী দাস
-তোমার আর কতক্ষণ গো…? ইশ্ এই শাড়িটা পড়বে বিচ্ছিরি সাদা মতো, দাঁড়াও এই, এই রেডটা পর তোমায় দারুণ মানাবে আর প্লিজ আমার স্যুটটা রেডি করে রাখো না…
বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল রুকু…
জীবনের প্রতিটা স্তবকে নিজের নয় অন্যের ইচ্ছা পূরণের দাবি দিয়ে সাজানো প্রত্যুশার…
– প্রত্যুশা ম্যামকে আমরা অনুরোধ জানাব তৃতীয় বর্ষের বিদায়ী ছাত্র-ছাত্রীদের আগামী জীবনের উদ্দেশ্যে কিছু উপদেশ দেওয়ার জন্য….
– ম্যাম কি দারুণ কথা বলেন তাই না.! যেন আমাদের মনের কথাগুলো ওনার সব জানা… আর কি দারুণ দেখতেও লাগছিল ওনাকে …
রোজই প্রত্যুশা কলেজ যায় গাড়িতে, ফেরেও গাড়িতে, কোথাও যেতে ইচ্ছা হয় না ওর, এছাড়া যাওয়ার হলেই ১০দিন আগে থেকে রুকুকে বলতে হবে…এটা যদিও নতুন নয়, বিয়ের আগেও এরকমই বন্দি জীবন ছিল, নিজের ইচ্ছাগুলোকে এড়িয়ে চলতে অভ্যস্ত ও অনেক ছোট থেকেই…
-আজ মনটায় কেমন একটা খারাপ লাগা ভর করেছে, হয়তো ওই ছেলেমেয়েগুলোর জন্য, বিশেষ করে করবী বলে মেয়েটার জন্য… কি উৎফুল্লতা দিয়ে সাজানো ওর জীবন, মেয়েটা বড্ড আদুরে আর মাতিয়ে রাখে সকলকে, ….আজ ও আমাকে একটা কার্ড গিফট্ করেছে, বাড়িতে গিয়ে তবে ভেতরটা পড়তে বলেছে আবার.!সত্যি পাগল মেয়ে একটা..!
বাড়ি পৌঁছে মালতীদিকে চা দিতে বলে সোজা ঘরে গিয়ে কার্ডটা নিয়ে বসল প্রত্যুশা…
প্রত্যুশা বছর ২৮/ ২৯ এর মেয়ে মাত্র ২বছর বিয়ে হয়েছে এরমধ্যেই তার সব ইচ্ছা পুরোপুরি রুকুর দখলে হয়ে গেছে..
প্রত্যুশার জীবন অসীম জ্ঞানের ফুলেফুলে সাজানো, আর শান্ত গলায় অল্প শব্দে সবার মনে জায়গা করার দক্ষতা ছোট থেকেই, যদিও এটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র তার বাবা মায়ের জন্যই..
কার্ডের মধ্যে ছড়িয়ে আছে করবীর চোখে প্রত্যুশার গল্প, শেষে করবীর ইচ্ছা দ্বিতীয় প্রত্যুশা হওয়ার, সেটাও স্পষ্ট…
-পাগলী মেয়েটার শখ্ জীবনে আমার মতো হওয়ার…
ওরই বা কি দোষ..! মুখোশর আড়ালে অভিশপ্ত প্রত্যুশাকে কেউ চেনেনি, সবাই আমার বাহ্যিক অসংখ্য ডিগ্রী ও বিপুল শুষ্ক জ্ঞানে মোড়া ধারালো প্রত্যুশাকে চিনেছে..
কে বুঝতে চেয়েছে আমাকে! আমার ইচ্ছা,আমার সত্যিকারের ভালো থাকাকে?
সেই মেয়েবেলায় রান্নাবাটি, পুতুল, ধরাধরি,এক্কা দোক্কায় যখন অন্যরা মত্ত, আমি তখন থেকেই ব্যস্ত, মায়ের চোখ রাঙানিতে বইয়ের অক্ষর চিনতে, যখন একটু বড় হলাম মনটা ছট্-ফট্ করত কিছু আঁকার জন্য, দাদাুর দেওয়া রং পেনসিল কেড়ে ৪টে অংক দিয়ে খাতা ধরিয়েছিল মা তখন, আমার কোনো বন্ধুও ছিলনা দুু’ একজন ছাড়া… সবাই জন্মদিনে যখন অনেক খেলনা উপহার পেত, আমি পেতাম বিভিন্ন জ্ঞানের বই, আমি মেনে নিয়েছিলাম আমার মেয়েবেলার মধ্যে বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণের অধিকারকে, আমি এতটাই আজ বিজ্ঞ যে আমি একটা কাগজের নৌকাও ঠিক মতো বানাতে জানিনা..! আজ আমার কোনো বন্ধুও নেই, সোস্যাল মিডিয়ায় হাই হ্যালো ছাড়া…, সবাই ভাবে আমার হয়তো খুব ঘ্যাম, কিন্তু কি করে বোঝাই আমি যে মিশতে পারি না সবার সাথে,আমি ভুলে গেছি মিশতে,…
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরও ভেবে চললো নিজের মনেই,
-তারপর মনে আছে, আমার খুব ভাললাগতো হাওয়ায় ভাসা ঘুড়িদের দেখতে.. তাই পড়তে বসে যাতে আমার মন বিচ্যুত না হয় অন্যত্র, জানলাগুলোও বন্ধ হতে থাকল বিকেল হতেই, কোনোদিন আমি গলা ছেড়ে একটা চলতি হিন্দি গান গাইতে পারিনি ঠোঁট ফাঁক হলেই সেটা হওয়া চাই কিছু ঐত্যিহ্য সম্পন্ন গান বা কবিতা, প্রতিবাদ জানিয়ে ছিলাম কয়েকবার, কিন্তু বাবার গম্ভীর স্বরে একটা আরশোলার মতো ভয়ানক কিছু আছে যেটার সামনে সবই ফিউজ্…
আমার সাফল্যে আমার থেকে বেশি খুশি হত আত্মীয়রা, আমার ঘর বোঝাই হতো পুরস্কারে আর আমি চোখের জলে নিজের ইচ্ছেদের ভাসিয়েছি…. আর আমার ইচ্ছেডানা খসে গেছে সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়ার যুদ্ধে… তাই আমার সব শিকলের বাঁধনকেই আমি ভালোবেসেছিলাম একে একে….
কিন্তু হয়তো সেজন্যই আজ আমি প্রতিষ্ঠিত নারী, অনেকের আইডল,বাবা মা এটাই তো চেয়েছিলেন, তাদের চাওয়ায় ভুল ছিল না কিছু, শুধু ভুল ছিল আমার জীবনে মেয়েবেলা বলে সেই সময়টা থাকাটা…
এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এসেছে, ভিজছে ওর পায়ের পাতা, ভিজছে ওর মন…
-ওরে বোকা করবী, তুই আমার মতো হতে চাস..! কিন্তু আমি যে অন্যের ইচ্ছার দাসী, ছোট থেকে আজ অবধি। এটাই আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি সত্যি… আর এটাও সত্যি আমি তোর মতো তোদের মতো,সাধারণ একটা ডানপিটে জীবন শুরু করতে চাই প্রথম থেকে..
বসন্তের শেষে যেভাবে গাছের শেষ পাতাটা ঝরে তার সমস্ত পাপ নিকড়ে দেয় নতুনের আশায় তেমনই হয়তো নতুন প্রাণ সৃষ্টির খবর এলো প্রত্যুশাকে আনন্দে ঢেকে….
প্রত্যুশা মনে মনে ভাবে,
– এবার আমি আমার মতো করে শৈশব গড়বো, অন্যের পছন্দের লাল হলুদে নয় , আমার গর্ভের ছোট্ট প্রাণটার নিষ্পাপ ছোট্টবেলার ইচ্ছেডানার আবদারে, আমার নষ্ট মেয়েবেলার আপসোসের ভুল আর হতে দেব না, বরং আমি ওর হাত ধরে ছোটবেলার প্রতিটা অনুভূতির স্পর্শ মেখে, রাঙাবো আমার হারিয়ে যাওয়া নিজের মেয়েবেলাকে..